কাজের তাগিদে, রুজির তাগিদে যেতে হয় ঠিকই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, সুন্দরবন যেতে আমার আর ভাল লাগেনা। সে কোন ’৭৩ সাল। বাবা মায়ের (প্রয়াত শিক্ষাবিদ্ ড.সুকুমার গুপ্ত এবং প্রয়াত চিকিৎসক ডা. শ্রীমতি ইরা গুপ্ত) হাত ধরে আমার প্রথম সুন্দরবন ভ্রমণ। তারপর অসংখ্য বার। কখন তথ্যচিত্র বানাতে, কখন বা বাঘ, মাছ, কাঁকড়া, কুমির কিংবা গাছ পর্যবেক্ষন করতেয়ার ইদানীং যেতে হচ্ছে বিদেশি গবেষকদের গাইড হিসেবে।কিন্তু কে জানত, সেই ছেলেবেলার প্রেমই আমাকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে! নোনাজলে, ঘোলাজলের পাকদন্ডি বেয়ে আজ ভেসে বেরাচ্ছি খাঁড়ির আনাচ-কানাচে। প্রকৃতি দেবীর নানান বৈচিত্র, নানান খামখেয়ালিপনা একাধারে যেমন আফুরান বিস্ময় জাগিয়েছে। অন্যদিকে তেমনই বিস্ময় জাগিয়েছে মনুষ্য প্রশাসনের প্রকৃতি-নির্বোধ, অর্বাচীন কাজকর্ম। এই সুন্দরবনের বিলুপ্তি ঠেকাবে কোন শক্তি?


সুন্দরবনে ‘সুন্দরী’ গাছ(হেরিটিরেয়া ফোমিস)কমে যাওয়া তারই পূর্বাভাস! তবে নামের গুণে ‘সুন্দরী’ গুরুত্ব পেলেও, প্রথম সারির বাদা প্রজাতির মধ্যে দ্রুত কমে আসছে ভোরা(রোইজোফোরা এপিকুলেটা), কাঁকড়া(ব্রুগুইয়েরা সেক্সাংগুলা), বকুল কাঁকড়া(ব্রুগুইয়েরা পারভিফ্লোরা), চাককেওড়া(সুন্নারেশিয়া ক্যাসিওলারিস), ওড়া(সুন্নারেশিয়া এ্যালবা), আমূর(অ্যাবলাইয়া কুকুল্লাটা)। লতা সুন্দরী(ব্রাউন লোবিয়া ল্যানসিওল্যাটা), টাগরিবাণী(স্কাইফিফোরা হাইড্রোফাইলেসিয়া) এবং লতা হরগোজা(অ্যাকান্থাস ভলুবিলিস)। এছাড়া দ্বিতীয় সারির বাদার মধ্যে বনলেবু, চুলিয়াকাঁটা, সিঙ্গার, বনভেন্ডি কিংবা কোরালি’র উপস্থিতিও সমানুপাতিক হারে কমে আসছে! আর তা হবে না-ই বা কেন? বাস্তুতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী, একই অঞ্চলে প্রত্যেকটি প্রজাতির মধ্যেই নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। একে অপরের পরিপূরক। ব্যপারটা আমাদের সমাজ জীবন এর মত। আমার পাড়ার দোকানী, দুধওলা, লন্ড্রি সকলের সঙ্গেই তো আমার সম্পর্ক রয়েছে। তা না হলে বাঁচব কি-করে! তাদের তো আমাকে প্রয়োজন। একেই বলে সহাবস্থান অর্থাৎ পারস্পরিক বোঝাপড়া। জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্রেও তার ব্যতিক্রম দেখিনি। সেই সম্পক গভীর(আমাদের অদৃশ্য)। যা কিনা প্রচলিত খাদ্য-খাদক সম্পর্কের অনেক উর্ধ্বে। জলের নিচে বাস্তুতন্ত্র আমার দেখার সুযোগ হয়নি। তবে দৃঢ় বিশ্বাস সেখানেও একই ব্যবস্থা। সুন্দরবনের ক্ষেত্রে যদি বলি বাঘের সঙ্গে ‘কালাবান’ এর (অ্যাভিসিন্নিয়া এ্যালবা) প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে, তাহলে হয়ত অনেকে হাসবেন। কিংবা রেস্যাস বানরের(ম্যাকাকা মালাটা) সঙ্গে ‘হরভজা’(এ্যাকান্থাস ইলিসিঝোলিয়াস) ইত্যাদি। না, প্রসঙ্গচ্যূত হয়ে যাচ্ছি। আমার এই এক মহা সমস্যা। জন্তু পর্যায় এসব নিয়ে আলোচনা করব। এখন ‘সুন্দরী’।
গত মাসেই আমার এক বিদেশিনী গবেষককে নিয়ে সুন্দরবন গেছিলাম। ওর নাম এ্যাঞ্জেলি মিলার। ২৮বছরের ড্যানিস মেয়ে। অসীম সাহসী, ততোধিক বিনয়ী। একা একা বিভিন্ন দেশ ঘুরে বাদা প্রজাতির উদ্ভিদের উপর গবেষণা করছে। এখানে এসেছিল ‘সুন্দরীর’ খোঁজে। এখন মায়ানমার গেছে। কাল রাতেই ফোন করেছিল। ফোন তুলতেই প্রথম কথা,“স্যার, ইয়েট টু ফাইন্ড অ্য সিঙ্গল ফোমিস”। আমি মজা করে বললাম, “য়্যু ক্যান ফাইন্ড”। “বাট্ হোয়ার স্যর?” “গো ইন ফ্রন্ট অ্যা বিগ্ মির্যমর!”। ফোন কেটে গেল। আমি আর ‘কল ব্যাক’ করিনি। কী হবে করে! আমিও তো এখানে ‘সুন্দরী’ কে মিস করছি।করছে আমার মতো আর হাজার-লক্ষ মানুষ! তাতে তার কীই বা গেল এল? সুন্দরী থাকছেনা, থাকবেনা। তাকে বাদ দিয়ে ভাব। সমাজ আমাদের শিখিয়েছে, কেউ অপরিহার্য নয়! ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে হবে। আবেগ্ধরে রেখো না(যা আমরা/ভোটার বোঝেনা, তাই আবেগ)! কে জানতে যাচ্ছে সুন্দরীর বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব, কী-ই বা তার গুণাগুণ? ইংরেজিতে একটা ছোট্ট ফ্রেজ আছে- “নো বডি বোদার্স”। কিছু বলতে গেলেই ক্ষমতাবান, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ বিজ্ঞানের মোড়কে দু-ছত্র ‘টেকনো’ জ্ঞান ফলিয়ে দেবে(আধা বা সিকি জ্ঞান)। বেশ কয়েক বছর আগে একবার সুন্দরী সংরক্ষণের কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছিলাম। তৎকালীন সুন্দরবনের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক গুরুগম্ভীরভাবে আমাকে বললেন, “গুপ্তাজি, ওটা তো ‘লো-স্যলিনিক প্লান্ট। আমাদের সুন্দরবনে বিশেষ হয়না। তবু, উই হ্যাব প্লান। সাউথ ২৪পরগণার দিকে রি-ইনট্রোডিউস করা হবে”। আমি সেদিন স্তম্ভিত হয়েছিলাম। ভদ্রলোক বলে কি! তবুও কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে ফস্ করে জিজ্ঞেস করেছিলাম “ তা সাউথ ২৪পরগণার কোথায়? বাসন্তী, কুলতলি, পাথর, নামখানা, কাকদ্বীপ না সাগর?” আধিকারিক ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, “ইয়েস-দ্যাট সাইড ওনলি!”
পাঠকদের একটুও ভনিতা না করে বলছি, বিশ্বাস করুন উত্তর শুনে নিমেষের জন্য আমার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেছিল। স্বগোতক্তি করে বলেছিলাম “হে ঈশ্বর, তুমি এদের লক্ষ টাকা মাইনে দাও, এ্যারিয়ার দাও, প্রোমোশন দাও। তাতে আমার কন দুঃখ নেই। বিন্দুমাত্র হিংসা নেই। কিন্তু তুমি এদের ক্ষমা কর। এরা কী অন্যায় করছে তা এরা নিজেরাই জানে না”। হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন। সেই সময় নিজেকে যীশুখ্রীষ্টেরপরম শিষ্য মনে হয়েছিল। কোন কিছু না জানা টা অন্যায় নয়। কিন্তু কোন কিছুর দায়িত্ব নিয়ে কেবলমাত্র আত্মাম্ভরিতা দেখিয়ে প্রয়োজনীয় বিষ্য জানতে না চাওয়াটা চরম অন্যায়। যা দিনের পর দিন এই ক্ষমতাবান মানুষেরা করে যান। আর জঙ্গলের ক্ষেত্রে তার মুল্য দেয় সুন্দরী, কাঁকড়া, বাঘ, সিংহ, হাতি, গন্ডারের মত অবলা জীব বা উদ্ভিদকূল। “এ খেলা চলছে নিরন্তর...এ খেলা চলবে নিরন্তর...”!
পাঠকরা অনেকেই জানেন, এই সুন্দরী গাছ আর সুন্দরী মনুষ্য রমণীর ভাবগতিক অনেক্তা একই রকম। অসম্ভব মুডী এবং খুঁতখুঁতে। পান থেকে চুন খসলেই নিজেকে সন্তর্পণে গুতিয়ে নেবে। আর সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে, নিজেকে উজার করে মেলে ধরবে। বৃক্ষ ‘সুন্দরী’ও তাই। লবনাম্বু বৃক্ষ(হ্যালফাইট) কিন্তু মিষ্টি জলের প্রবাহ বেশি চাই! আবার পুরপুরি মিষ্টি জল হলেও চলবেনা। তাতে নির্দিষ্ট মাত্রায় নুনের উপস্থিতি থাকতে হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বড়জোর ৫-১৫ পি.এস.উ.(প্র্যাকটিকাল স্যালিনিটি ইউনিট)। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতীয় সুন্দরবনে যা প্রায় বিরল। এটা সেখানেই সম্ভব, যেখানে খরস্রোতা নদী এসে সমুদ্রে মিশেছে। সেই নদীর মোহনার খানিক আগে অর্থাৎ অপরের দিকে(৫০-১০০কিমি সমুদ্র দূরত্বে)জলের লবণমান ঐ রকম থাকে। আবার অঞ্চল বিশেষে এবং সময় বিশেষে তার তারতম্য ঘটে। সেই খরস্রোতা নদী সুন্দরবনে আজ আর নেই। একসময় ছিল। “ফারাক্কা ব্যারেজ” তৈরী হওয়ার পর কফিনে শেষ পেরেকটা গেঁথে গেছে। “আল্লার সঙ্গে পাল্লা” দিয়েছিলেন আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঈন্দিরা গান্ধী! সেচ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে গিয়ে বাদাবন তহ দূরের কথা বরং গোটা গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের অস্তিত্বটাকেই বিপন্ন করে গেছেন! হায় উন্নয়ন, ‘যোগফলের ভ্রান্তি’ বা ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফ্যালাসী অফ এগ্রিগেশন’। নদীর চলমান প্রবাহের মাঝে বাঁধ দিলে নিচের দিকে মিষ্টি জলের প্রবাহ কমবে এবং জলের সঙ্গে বালিও আটকে থাকবে আর সেই বালির স্তূপ জমে নদীর নব্যতা কমাবে- এসব চিন্তা তখন তামাম বিজ্ঞানী আর রাষ্ট্রনায়কদের মাথায় আসেনি! ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। গঙ্গা, হুগলী, পদ্মা সব নদীতেই মিষ্টি জলের প্রবাহ কমছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। যার অন্যতম নিদর্শণ সুন্দরী গাছ। এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট(২০১৫-১৬) দেখে চমকে উঠলাম। গঙ্গা-সাফাই অভিযানের অর্থে ১০০ শতাংশ কর মুকুব। তা বনি গঙ্গার কি সাফাই হবে? আবর্জনা? না, তা তো নয়! বরং বলা ভাল বালি সাফাই অভিযান! কিন্তু তা আবার বলা যাবেনা। বললে নিজের থুথু নিজের গায়েই ছিটবে। আর ভুল স্বীকার করলে টাকাও উঠবেনা। তার চেয়ে ভাষার সামান্য রদবদল ঘটানই শ্রেয়। এতে করে প্রলোভন দেখিয়ে টাকা তোলা সহজ হবে। অভিনব পন্থা(অকপটে ভুল স্বীকার)!
এ তো গেল বাঁধের কথা। তার উপর রয়েছে নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকার পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে হেলে পড়ার কারণ। ভূ-বিজ্ঞানীরা বলেন “নিও-ট্যাকটনিক মুভমেন্ট এ্যান্ড টিলটিং এ্যাফেক্ট”। ওতা আমাদের হাতে নয়।প্রকৃতি মায়ের লীলা কিংবা তাঁরকোন সুদূরপ্রসারী বৈজ্ঞানিক চিন্তা। কিন্তু নদীপ্রবাহের গতি আমরাই নষ্ট করেছি। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ফারাক্কা বাঁধের দরুণ গঙ্গা-পদ্মার সঙ্গে সুন্দরবনের নদীগুলির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। হুগলী নদীতে মিষ্টি জলের প্রবাহ কমেছে। ফলে সুন্দরবনের পশ্চিম দিকে হুগলী মোহনা থেকে শুরু করে একে একে গোসাবা, ঠাকুরানি, যামিরা, সপ্তমুখি, বারাতলা এবং মাতলা নদী ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে। একসময় এই মাতলা নদী ছিল সুন্দরবনের অন্যতম বৃহত্তম নদী। বড় বড় জাহাজ এই মাতলা পথে পোর্টক্যানিং যাতায়াত করত। এ দৃশ্য আমিও দেখেছি। আর আজ? ভাঁটার সময় ছোট ডিঙি নৌকাও বালির চরে আটকে যায়। তখন আমরা ক্যানিং থেকে ভুটভুটি নিয়ে সুন্দরবন যেতাম। আজ যাই গতখালি দিয়ে। ব্রিটিশদের স্বপ্নের পোর্টক্যানিং ইতিহাসের পাতায় আবদ্ধ থাকবে। নদীর জল বা মিষ্টিজলের প্রবাহ কমে আসার ফলে সুন্দরবনের নদীগুলোতে সামুদ্রিক নোনাজলের বিস্তার বেড়ে চলেছে। বেড়েছে জলের লবণাক্ততা। বিশেষ করে পশ্চিমদিকে। সেখানে লবণমান নির্দিষ্ট থাকছে না। আগে বলেছি, আবারও বলছি, সুন্দরবনের এই অকাল বিপদের জন্য অন্যতম দায়ী হল ‘ফারাক্কা ব্যারেজ’! এই অপরিণামদর্শী কাজের জন্য ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবেনা। গোটা নিম্ন-গাঙ্গেয় উপত্যকাকেই এর মূল্য চোকাতে হবে। যার অন্যতম হল দক্ষিণ ২৪পরগণা জেলা। এখানে নদীর জলে লবণাক্ততা বিস্ময়কর। জম্বুদ্বীপে কমছে, আবার সপ্তমুখানিতে বাড়ছে। দুটো জায়গাই সুন্দরবনের পশ্চিমদিকে অবস্থান করছে! আবার গড় দেখলে গোটা পশ্চিমদিকের লবণাক্ততা নাকি কমছে। অন্তত গবেষকরা তাই বলছেন। তাঁদের মতে বিগত ২৪ বছরে ভারতীয় সুন্দরবনের এই পশ্চিমভাগে জলের লবণাক্ততা ১৬.৫ শতাংশ কমেছে! সুতরাং এই চরম অনিশ্চয়তার মাঝে, ‘সুন্দরী’র মত ‘সেন্সেটিভ’ গাছের আর যে কোন সম্ভাবনা নেই, তা বলাই বাহুল্য। অথচ আমাকে সেই আধিকারিক জানিয়েছিলেন যে তাঁদের নাকি এই দিকেই ‘সুন্দরী রি-ইন্ট্রোডিউস’ করার প্ল্যান আছে! আসলে এই রিপোর্ট দেখে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন। তাহলে কলসদ্বীপে যে কয়েকটা সুন্দরী গাছ লাগানো হয়েছিল, সেগুলো তরতর করে বেড়ে উঠতো। বাস্তবে তা হয়নি তো বটেই বরং উল্টোটাই হয়েছে। সব’কটা গাছ ক্যাঁৎ মেরে কোনক্রমে বেঁচে আছে। জটিল প্রাকৃতিক বিষয়ে “ওয়ান টাইম স্যাম্পেলিং” করে কি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছোন যায়? কি জানি বাবা!
সে যাইহোক এ তো গেল ভারতীয় সুন্দরবনের পশ্চিমদিকের কথা। এরপর কেন্দ্রিয় অঞ্চল অর্থাৎ ঠাকুরান, ধুলিভাসানি, চুলকাটি, গোয়াসাবা, মাতলা কিংবা পিরখালির জলে লবণমান অনেক বেশি। গবেষকরাও তাই বলছেন। তাঁদের মতে বিগত ২৪ বছরে ভারতীয় সুন্দরবনের কেন্দ্রিয় অঞ্চলে জলের লবণাক্ততা ৯.৫ শতাংশ বেড়ে গেছে! সুতরাং এদিকে ‘সুন্দরী’র কোন ‘চান্স’ নেই।
আর বাকি পড়ে রইল পূর্বদিক। অর্থাৎ বাংলাদেশ সীমানা বরাবর। হ্যাঁ, ওদিককার জলে লবণমান কম। এরমধ্যে রয়েছে যেমন ঝিলা’র জঙ্গল, আরাবেশি, হরিণভাঙা, বুড়িরডাবরি, খাটুয়াঝুড়ি কিংবা খানিকটা চাঁদখালি’র জঙ্গল। বিজ্ঞানীদের দাবি, ওদিকে লবণমান বিগত ২৪ বছরে প্রায় ২২ শতাংশ কমে গেছে! সে যাই হোক, আমি বিজ্ঞানী নই। সংখ্যাতত্ত্ব বিচারে না গিয়েও এটুকু বলতে পারি, পূর্বদিকে লবণাক্ততা কম। আর সেই কারণেই ভারতীয় সুন্দরবনে যে কতিপয় ‘সুন্দরী’র অস্তিত্ত্ব আছে তা ওই পূর্বদিকে। আর কথাও নয়। তাই এ্যাঞ্জেলা’কে নিয়ে ওদিকেই গিয়েছিলাম। ও খুশি হয়েছিল। লতা-পাতা-ছাল-বাকল যা পেল, বস্তা বোঝাই করে নিয়ে গেল। জানিনা কি করবে, আর তাতে করে ‘সুন্দরী’র কি-ই বা লাভ হবে! আমাদের সুন্দরবনে ফিরে আসবেনা ‘সুন্দরী’ – এই বাস্তব মেনে নিয়েছি।
এবিষয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ আলোকপাত করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী ও গবেষক। তাঁরা পরিস্কার জানাচ্ছেন, অতিতে বাংলাদেশ সুন্দরবনকে দু-ভাগে ভাগ করা হত। এক, মিষ্টিগলের অঞ্চল এবং দুই, স্বাভাবিক লবণাক্ত অঞ্চল(কার্টিজ ১৯৩৩)। যা ফারাক্কা পরবর্তী সময় থেকে তাঁরা আর মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা নির্দিষ্ট সময়কালও উল্লেখ করছেন(ক্যাফি ও অন্যান্য ১৯৮৫)। অর্থাৎ ফারাক্কা বাঁধ কার্যকরী হওয়ার ১১/১২ বছর পর থেকে। বরং এই সময় থেকে বাংলাদেশ সুন্দরবনে জৈববৈচিত্রকে তাঁরা তিন ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। এক, মিষ্টিজলের অঞ্চল। দুই, স্বাভাবিক লবণাক্ত অঞ্চল এবং তিন হল লবণাক্ত অঞ্চল। আসাধারণ বিশ্লেষণ। অর্থাৎ ফারাক্কা পরবর্তী সময় ‘লবণাক্ত অঞ্চল’টি সুন্দরবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল (মিষ্টিজল বা নদীর জলের অভাবে)! আয়তনের দিক থেকে সেই সময় এই তিনটি অঞ্চলই প্রায় সমান ছিল বলে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন। কিন্তু পরবর্তী সময় সেই হিসেব লন্ডভন্ড হয়ে গেল! নয়ের দশক থেকেই সেখানে ৬০ শতাংশ লবণাক্ত অঞ্চল, ৩৫ শতাংশ স্বাভাবিক লবণাক্ত অঞ্চল এবং মাত্র ৫ শতাংশ মিষ্টিজলের অঞ্চল(করিম ১৯৯৪)! তবে ঢাকার বিজ্ঞানীরা আরও এক্তি অভূতপূর্ব কাজ করেছেন। তাঁরা বাংলাদেশে ছ’টি গুরুত্ত্বপূর্ণ বাদা অঞ্চল বেছে নিয়ে নিবিড় ‘সার্ভে’ করে জানাচ্ছেন, ওই ছ’টি অঞ্চলে মোট ‘সুন্দরী’ গাছের সংখ্যা মাত্র ১৩৭৫! তাম্বুলবুনিয়া(৬০৬), মরোভোদ্রা(৫৫০), পাটকোস্টা(১০৫), টেক্(১০০), অর্পনগাসিয়া(১০) এবং কোটকা বনাঞ্চলে তাঁরা মাত্র ৪টি ‘সুন্দরী’ গাছের সন্ধান পেয়েছেন! এখানে আরও বিস্ময়কর তথ্য হল ১৯৫৯ সালে সুন্দরবনে ‘সুন্দরী’ গাছের উপস্থিতির হার ছিল ৩১.৬ শতাংশ(ফরেস্টাল ১৯৬০)। ১৯৮৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২১.০১ শতাংশ(ক্যাফি এবং অন্যান্য ১৯৯৫)!
সুতরাং ওপরের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, আজ বাংলাদেশ সুন্দরবনেও ‘সুন্দরী’র অবস্থা ভাল নয়। তবে ভারতের চেয়ে অনেক ভাল। ওখানে বেশকিছু জায়গায় এখনও যথেষ্ট ঘনত্বে ‘সুন্দরী’ আছে। যেমন, তাম্বুলবুনিয়া, মরোভোদ্রা, পাটকোস্টা এবং টেক্ অঞ্চলের কথা আগেই বলেছি। তবে অর্পনগাসিয়া এবং কোটকা থেকে প্রায় নির্মুল হয়ে গেছে! আশার কথা এই যে, বাংলাদেশ সরকার এদিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ চলছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। ওনাদের গবেষণা পত্র থেকে আরও জানতে পারলাম যে, ১৯৮৯, ২০০০ এবং ২০১০ সালের মধ্যে একটা তুলনামূলক গবেষণার কাজ ওনারা সম্পন্ন করেছেন। যাতে করে এই তিন দশকে বাংলাদেশে মোট ‘সুন্দরী’র বন কমেছে ৬৬২০.১২ হেক্টর। জি.আই.এস. (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম-উপগ্রহের আগত) সাহায্যে ওনারা এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করতে সক্ষম হয়েছেন।
‘সুন্দরী’ গাছ সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে তার বিস্তার বিষয়ে খানিকটা আলোকপাত প্রয়োজন। এখানে প্রথমেই পাঠকদের জানিয়ে রাখি, এ এক বিচিত্র গাছ। কখন কোথায় হবে আর কখন সেখান থেকে উধাও হয়ে যাবে- তা আগাম অনুমান করা ভার। যদিও তার নেপথ্যে আসংখ্য বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ আছে। যার মধ্যে প্রধান একটি কারণ নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি। অন্যান্য কারণে পরে আসছি। এখানে যেটা লক্ষ্য করার মত বিষয়ে তা হল পৃথিবীর মোট ১১২টি দেশে বাদাবন নথিভুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, ওই সমস্ত দেশে ব-দ্বীপ বা খাঁড়ি যুক্ত মোহনা অঞ্চলে বাদা প্রজাতীয় উদ্ভিদের উপস্থিতি আছে। কিন্তু অবাক ব্যাপার, ১১২টি দেশের মধ্যে ‘সুন্দরী’র উপস্থিতি আহে মাত্র ৫টি দেশে! দেশ গুলি হল মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, বাংলাদেশ এবং ভারত। এর মধ্যে মায়ানমারে কেবলমাত্র ইরাউডি অঞ্চলে এবং ভারত-বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলই হল এর আদি বাসভূমি। পাশের মানচিত্র দেখলে বিষয়টা আরো পরিস্কার হবে।
২০০৮ সালের ‘এ্যাসেসমেন্ট’ অনুযায়ী ২০১০ এ আই.ইউ.সি.এন. ‘সুন্দরী’কে ‘এ্যানডেঞ্জার্ড’ বলে ঘোষণা করে। রেড ডেটা বুক এ তার নাম উঠে যায়। কিন্তু কেন এই হাল? আই.ইউ.সি.এন. সূত্রে জানা যাচ্ছে, ‘সুন্দরী’র সবচেয়ে বড় আধার ছিল মালয়েশিয়া। যা আজ প্রায় নিশেষিত। সে দেশে বিগত ৬০বছরে প্রায় ৫০-৮০ শতাংশ ‘সুন্দরী’ বন শেষ হয়ে গেছে। যার প্রধান কারণ হিসেবে কাঠের চাহিদা বৃদ্ধি, সমুদ্র উপকূল উন্নয়ন, বল্গাহীন চিংড়ি চাষ এবং বন কেটে কৃষি বিস্তারকেই দায়ী করা হচ্ছে। চিংড়ি চাষ এক মারাত্মক বিষয়। অসংখ্য পুকুর কেটে সেখানে নোনাজল ঢোকানো হয়। বিশেষ করে মিষ্টিজল প্রবণ এলাকায় যা হল ‘সুন্দরী’র আদর্শ বাসভূমি(অনগ, ১৯৯৫, ২০০৩)। ফলে সামগ্রিক ভাবে সেই গোটা অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। থাইল্যান্ডেও সেই একই দশা। সেখানে আবার এর সঙ্গে পর্যটন এবং নারকোল চাষ যুক্ত হয়েছে। মায়ানমার, বাংলাদেশ এবং ভারতে এখনো ‘সুন্দরী’র অস্তিত্ব থাকলেও, জায়গা বিশেষে তা ‘ক্রিটিক্যালি এ্যান্ডেঞ্জার্ড’ হয়ে পরেছে(ভীষণ ভাবে আঞ্চলিক)। অবস্থা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা কম। ভারতীয় সুন্দরবনে এর উপস্থিতির হার প্রতি ১০০ গাছে মাত্র ৬(ক্যাথিরিসান ২০০৮)! আর বাংলাদেশের কথা তো আগেই আলোচনা করেছি। সুতরাং এই হল ‘সুন্দরী’র বিশ্বজনিন অবস্থা। অথচ আমরা নির্বিকার!
তবে এই কারণ গুলো ছাড়াও ‘সুন্দরী’ শেষ হওয়ার পিছনে আরও দুতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। যার মধ্যে মারাত্মক হল ‘টপ ডাইং ডিজিস’। এ এক ধরণের মড়ক। গাছেদের মধ্যে যা কেবলমাত্র ‘সুন্দরী’র ক্ষেত্রেই দেখা যায়। পাতার নিচে, ডালের খাঁজে, কান্ডে ছোট ছোট গুটির মত হয় এবং মাথার দিক থেকে গাছ শুকোতে শুরু করে। ক্রমে তা সারা গাছে ছড়িয়ে পড়ে। বিগত শতাদ্বির গোড়া থেকেই ‘সুন্দরী’ এই ব্যামো নথিভুক্ত হয়ে আসছে। কিন্তু আজ বিজ্ঞানীরা তার নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাননি। বলা হচ্ছে জলে এবং বাতাসে ভারি ধাতব কণা বেরে যাওয়ার ফলেই হয়ত এমনটা হচ্ছে। এদের পরিবেশগত সহনশীলতা ভীষণ কম। পাঠকরা যাঁরা এই রচনাটি গোড়া থেকে পড়ে আসছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই তা উপলব্ধি করতে পারছেন তবে এটা একটা গুরুগম্ভীর বিষয়ে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি এর শিকড়ে পৌঁছোতে গেলে ‘ফাইলা জেনেটিক্স’ এবং ‘স্পিসিস লাইফ’ পর্যায়ের গবেষণা প্রয়োজন। এই নিবন্ধে তার প্রয়োজন নেই। অতএব, সত্যি সত্যিই যদি আমরা ‘সুন্দরী’কে প্রকৃতির বুকে টিকিয়ে রাখতে চাই, তাহলে অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি এই ‘টপ ডাইং ডিজিস’ – এর বিজ্ঞান ভিত্তিক মকাবিলা আশু কর্তব্য। ভারত, বাংলাদেশ দু’দেশের সরকারকেই এব্যপারে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃতিতে ‘সুন্দরী’র গুরুত্ব অপরিসীম। সে বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনায় আসছি। কিন্তু তারও আগে আরেকটি সাঙ্ঘাতিক সমস্যার কথা এখানে আবশ্যই উল্লেখ করা দরকার। এ সমস্যা ‘সুন্দরী’র জন্য এক বিশাল প্রতিবন্ধকতা, যার কোন প্রতিকার নেই।
এই সমস্যার সুত্রপাত হল সমুদ্রে জলস্তর বৃদ্ধি। ‘সুন্দরী’র মত ‘ব্যাক ম্যানগ্রোভ’ বা দ্বিতীয় সারির বাদা প্রজাতির ক্ষেত্রে এ এক গুরুতর সমস্যা। সামনে সমুদ্র, পেছনে উন্নয়ন! অবস্থার প্রেক্ষিতে কি ভাবে বাসভূমি পরিবর্তণ করবে তারা? একতি নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রত্যেক বাদা প্রজাতির অস্তিত্ব নির্ভর করে বাসভূমির উচ্চতা, সমুদ্র বা নদীর জল তরঙ্গ, লবণাক্ততা এবং ঢেউ-এর ধারাবাহিক সময়সূচীর উপর(ডিউক ও অন্যান্যরা, ১৯৯৮)। এই ছন্দে কনরকম বিঘ্ন ঘটলেই সেই উপদ্রুত অঞ্চলে ভুক্তভোগি বৃক্ষরাজির বাসভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। ব্যপারটা ঠিক সাপ, ইঁদুর কিংবা পিঁপড়ের গর্তে জল ঢোকার মত। বাদা উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজিতে একে বলে “Morality at present locations and re-establish at higher elevations in areas that were previously landward zones(Ellison 2005).” এ ঘটনা বহুবার নিজের চোখে চাক্ষুস করেছি। বিশেষ করে ধানি ঘাসের ক্ষেত্রে(পোর্টেরিসিয়া কোয়ার্কটাটা)। এই সমস্যার কোন সুদূরপ্রসারী সমাধান সূত্র নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে ‘ইন-সিটু’র পাশাপাশি ‘সুন্দরী’র ‘এক্স-সিটু’ সংরক্ষণ এবং ‘ক্যাপটিভ-ব্রিডিং’ এর কথা আবশ্যই ভাবতে হবে। অর্থাৎ চিড়িয়াখানায় রাখা জীবজন্তুদের মত ব্যবস্থা। যাতে করে কোন কারণে প্রকৃতি থেকে ‘সুন্দরী’ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তার ‘জার্ম-প্লাজম’ যেন সংরক্ষিত থাকে। কারণ হল গিয়ে ‘সুন্দরী’র ঔষধি-গুণ মারাত্মক। বিশেষজ্ঞদের মতে ‘সুন্দরী’ গাছের বিভিন্ন অংশ সুন্দবনের স্থানীয় মানুষ বিভিন্ন রকম রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন, ‘সুন্দরী’ গাছের পাতা এবং বীজ ব্যবহৃত হয় ডায়রিয়া, আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য, অম্লতা, বদহজম, পেটব্যথা প্রভৃতি রোগের উপশম হিসাবে। আবার এই গাছের ছাল ও কান্ড ডায়াবেটিস এবং বিভিন্ন রকম চর্ম রোগের জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে ‘সুন্দরী’ গাছের ঔষধি-গুণ এখনও সম্পূর্ণ ভাবে জানা যায়নি বলেই আমার বিশ্বাস। আর এইগুণের কারণেই কেবলমাত্র স্থানীয় ওষুধ তৈরি এবং তার বিশ্বজনীন চাহিদার যোগান দিতেই অসংখ্য ‘সুন্দরী’ গাছ কাটা পড়ে। হ্যাঁ, ‘সুন্দরী’ধর প্রতিটি দেশে এর প্রচলন রয়েছে।